বগল তত্ত্ব
New Lords, new lawsসাব-অর্ডিনেটরা উদ্বিগ্ন,
কেমন হবেন হুমায়ুন কবির,
নতুন বস।
যোগদানের দুদিনের মধে তিনি অফিসারদের বায়োডাটা কালেকশন করে নিয়েছেন।
মেধাবীরা খুশি।
বাংলাদেশে মেধার মূল্যায়ন হয় না,
এবার হবে। মেধা গুরুত্ব পাবে। দিন বদলাতে শুরু করেছে।
হুমায়ুন: নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য যোগ্য অফিসার রাখব। মেয়ে হলে ভাল হত, গাদ্দাফির মত।
জগদীশ, সেকেন্ড ইন কমান্ড বললেন হাসলেন: সেদিন বলেছিলেন মেয়ে বস ভাল না, বিদায় বেলা কোলাকোলি করা যায় না।
ন্ডমায়ুন: মেয়ে বস ভাল না হলেও সাবঅর্ডিনেট ভাল। বউয়ের চেয়ে শালীর রূপ, ইচ্ছে করে দিতে ডুব।
হোসেন, থার্ড ইন কমান্ড, আফসোসের গলায় বললেন: এ রকম যোগ্য অফিসার কি স্যার পাওয়া যাবে?
হমায়ুন: বের করে নেব। একজনই এনাফ, নতুবা খালি। গাভি একটা যদি তিনটার দুধ দেয় তো অযথা তিনটা পুষবো কেন?
পরীক্ষা শুরু করে দুদিন পর।
প্রথমে ঢুকেন কবির।
স্মার্ট অফিসার। যেমন কথা তেমন কাজ; বেশ চোস্ত।
হুমায়ুন: জামা খোল, বগল দেখাও
আদেশ শুনে কবিরের চোখ ছানাবড়া। তবু আদেশ পালন করে। চাকরের কাজ আদেশ পালন করা।
বগল দেখে হুমায়ুন কবির অবাক। চকচকে, কেশের চিহ্নমাত্র নেই।
হুমায়ুন নাক সিট্কে হুলো বিড়ালের আওয়াজ দেন: তুমি কাজ করো কখন? বগলে যদি এত সময় দাও!
কবির: কাজের সময় কাজ।
ন্ডমায়ন: বশি স্মাট ভাল না। যাও, জামালকে পাঠাও।
জামাল বসার আগে হোসেন আদেশ দেন: জামা খোল, স্যার বগল দেখবেন।
জামা খুলে জামাল।
ছিমছাম শরীর। পাকা আপেলের মত চকচকে মুখে নিঁখুত রেখা। হুমায়ুন সাহেব জামালের বগলে চোখ রাখেন-
কেশ আছে তবে চিমটা ছাড়া ধরা সম্ভব নয়। গতকাল নয় তো পরশু পরিস্কার করেছে।
হুমায়ুন সাহেব চশমা মুছে চোখে আবার চোখে লাগান: সপ্তাহে কয়বার বগল কাটো?
কাটি না স্যার।
কী করো?
কাটাই।
কারে দিয়ে কাটাও।
নাপিত।
সপ্তাহে কয়দিন?
একবার।
কোনদিন?
শুক্রবার।
ঠিক আছে, যাও।
জামালের পর মোজাম্মেল।
কালো চোখ, সুঠাম গঠন, শক্তির আভাস। বসার আগে বলে উঠেন হুমায়ুন: বসতে হবে না, বগলটা দেখাও। উর্বরতা দেখি।
বোতাম খুলতে শুরু করে মোজাম্মেল।
থেতে উঠে হুমায়ুন: তাড়াতাড়ি কর। সময় কম। তোমাদের মত খচ্চরদের জন্য এক সেকে- সময় নষ্ট করতেও কষ্ট হয়।
ফটাফট জামা খুলে হাত দুটো উপরে তুলে মোজাম্মেল।
বগলের কেশ মোটামোটি লম্বা, তবে সবগুলো সমান নয়।
কী ব্যাপার? বগল-কেশের সাইজে এত হেরফের কেন? সবগুলো কি এক দিনে কাটো না?
মোজাম্মেল: দু-এক টানের বেশি দেই না। সময় কই স্যার!
কিন্তু কাটো তো এক সাথে, তো বড় ছোট কেন?
একই দিন জন্ম নিলেও সবার সাইজ সমান হয় না, স্যার।
যাও।
মোজাম্মেলের পর কাশেম, তারপর আরও কয়েক জন।
হুমায়ুন সাহেবের চেহারা মলিন হতে মলিনতর।
তিনি কি যেন খুজছিলেন। না পেয়ে ক্রমশ হতাশ, ক্ষুব্ধ।
সবার শেষে সারওয়ার।
ছয় ফুট।
দেখলে মনে হয় বলদ, কাজেও অমন;
শুধু গলদ।
বগল দেখাও, বিরক্তি নিয়ে বলে উঠেন হুমায়ুন সাহেব।
পারলে লাথি মারেন। লাথি দেয়ার জন্য তার পা দুটো উসখুস করছে।
জামা খুলে সরোয়ার, ভটকা গন্ধে চারিদিক মুচড়ে।
নাকে হাত রাখেন হোসেন, রুমাল রাখেন জগদীশ। হিন্দুদের কাজই আলাদা।
গন্ধে হুমায়ুন সাহেব উদ্বেল।
চেয়ার হতে লাফ দিয়ে সোজা সারওয়ারের বগলে।
গাভীর পিছ কল্লায় যেন বৃষের বদন, লম্বা শ্বাস নিয়ে আকাশে উগড়ে দিচ্ছে তৃপ্তি।
আহ্ কী শান্তি, কী শান্তি!!
সাড়ে সাত ইঞ্চি কেশ, নিশার চেয়েও গভীর। মনে হয় গত তিন বছর নিংড়োয়নি।
হুমায়ুন : ইউ আর রাইট,পারফেক্ট, এক্সেক্ট, সিরিয়াস, ইংরেজি আর বাংলা সাহিত্যের সবগুলো বিশেষণ তোমাকে দিলাম।
একগাল হাসিতে বগলের গন্ধ ছড়িয়ে বেরিয়ে যায় সারওয়ার।
বগলের মাহাত্ম্য দেখে জগদীশ ছানাবড়া।
হোসেন আক্ষেপে মলিন।
ইস! তার যদি অমন বগল থাকত তো এক্ষুণি জামা খুলে দেখাত। যতদিন হুমায়ুন স্যার থাকবেন ততদিন আর কাটবে না।
হোসেন: আমার কাছেও সারওয়ার বেস্ট। তবে আপনি কেন সারওয়ারকে বেস্ট ওয়ান হিসেবে চিহ্নিত করলেন স্যার?
উপহাসের কণ্ঠে জগদীশ বললেন: গ্রেট ম্যান থিংক্স এলাইক।
হুমায়ুন: সারওয়ার কাজের জন্য বগল কাটার সময় পায়নি। সরকারি চাকুরেদের বগল কেশহীন থাকতে পারে না। যাদের বগল পরিস্কার তারা ফাঁকিবাজ, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অনুর্বরতার লক্ষণও বটে।
হোসেন: ঠিক বলেছেন স্যার।
হুমায়ুন: গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো সারাওয়ার এবং মোজাম্মেলকে দেয়ার ব্যবস্থা কর।
বাকিরা?
দেখি, তাদের বগল কতদিন পরিষ্কার থাকে। এ ক্লিন স্টোন ডাজ নট গেদার এনি ময়েশ্চ।
জগদীশ বাবু এতক্ষণ হুমায়ুন সাহেবের কা- দেখছিলেন। এমন পাগলামো কখনও দেখেননি।
বললেন: সারওয়ার তো লেখা পড়ায় অক্কা। তাকে এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া কী ঠিক হবে?
হুমায়ুন: আমার জ্ঞানের দরকার নেই, দরকার কাজের। সে নবীন। তোমার রবীন্দ্রন্থাই তো বলে গেছেন, “ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা, আধ-মড়াদের ঘা দিয়ে তুই বাঁচা।” তুমি হিন্দু হয়ে রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করছ? এমন রাজাকার হিন্দু তো দেখিনি!
মরিয়া হয়ে উঠেন জগদীশ: সরোয়ার যেমন বোকা তেমন অজ্ঞ।
হুমায়ুন: কেউ চায় না কাজের ছেলেটা চালাক হোক। হবে হাবাগোবা, যা বলব তা-ই করবে। সারওয়ার তেমন একজন, বগল দেখে বুঝেছি।
একটু থেমে কলিং বেলে চাপ দেন হুমায়ুন।
জগদীশ : সারওয়ার একটা ভাল ড্রাফটও করতে পারবে না, কাজ চলবে কীভাবে?
হুমায়ুন: যত সমস্যা সব ভাল ড্রাফটে। ভাল ড্রাফটে চিঠি লিখবে প্রেমিকাকে, বউ-বসকে নয়। বসকে লিখতে হয় কাজের ড্রাফটে। বসেরা চিঠি পড়ে না, কেরানিরা পড়ে। অফিসারদের কয়জনই বা ভাল ড্রাফট করতে পারে শুনি?
হোসেন: ঠিক বলেছেন স্যার।
হুমায়ুন: যে অফিসার চিঠি লেখায় দক্ষ তাদের দিয়ে লেখানো উচিত না। তুমি লিখলে ঠিক আছে, কিন্তু তোমার বস যদি না বুঝে! যে কেরানি ফাইল শুরু করে তিনি যদি না বুঝে!
হোসেন: আমার এক কলিগ ছুটির দরখাস্তে লিখেছিলেন “কেলিকুঞ্চিকাকে নিয়ে দ্বারিকালয়ে যাওয়ার নিমিত্ত ছুটির প্রার্থনা”। কেলিকুঞ্চিকা আর দ্বারিকালয় শব্দের অর্থ বুঝানোর জন্য তাকে সচিবালয় পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। আর কোন দিন এমন লিখলে বিভাগীয় মামলা শুরুর হুমকি দিয়েছিলেন সচিব স্যার।
জগদীশ: প্রচ- বৃষ্টিতে এলাকা পানির নিচে। ক্যাবিনেট বন্যার রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে। শাহাদাত লিখলেন, “প্রচ- বারিপাতে পথঘাট ডুবে গেছে।” স্যার বারিপাত কেটে লিখে দেন, ‘বাড়িপথ’। নাক সিটকে বলেছিলেন: বারিপাত বলে কোন শব্দ অভিধানে নেই, আছে বাড়িপথ। এমন ভুল আর কর না। প্রতিবাদ করেনি শাহাদাত; বলেছিলেন, “জ্বী স্যার।”
ন্ডমায়ুন: বুঝেও না বুঝার ভান করছ কেন?
জগদীশ: আপনাকে স্যার পাবলিক ফাংশানে বক্তব্য দিতে হবে, তখন কী করবেন?
হুমায়ুন: তখন ভাল ড্রাফটারদের একজনকে দিয়ে লিখিয়ে নেব। ঘি ভাল, কিন্তু সবসময় না। বুড়ো বয়সে তো একদম নিষিদ্ধ। পুরানো ক্যাডারগুলো এখন বুড়ো। ভাল ছেলেরা জয়েন করলে প্রতিদিন ঘি খাওয়ার মত অবস্থা হবে।
হোসেন: আমারও স্যার একই কথা।
হুমায়ুন: আজিরদ্দিন, নাম শুনেছো?
হোসেন: জ্বী স্যার।
হুমায়ুন: কোন স্মার্ট লোকের সঙ্গে কথা বলতে গেলেও কাঁপতেন। তিনিও কমিশনার হয়েছিলেন।
জগদীশ আর যুক্তি খুঁজে পান না।
হুমায়ুন: বিডিএস কী জানো?
জগদীশ: জানি না স্যার।
বগল দাবা সিস্টেম। বগলে ফাইল নিয়ে ছুটোছুটি।
হোসেন: বুঝেছি স্যার।
হুমায়ুন: কলা বুঝেছেন। বগলে কেশ না থাকলে ফাইলের ঘষায় ঘা হয়ে যেতে পারে। তাই লম্বা কেশ প্রয়োজন। সিংহের কেশর অফিসারের বগল কেশ।
জগদীশ: কিন্তু গন্ধ?
হুমায়ুন: জগদীশ, তোমার যোগ্যতা দেখে আমি হতাশ। শাসক অফিসারদের শুধু বাঘ হলে চলে না। এট দ্যা সেইম টাইম শিয়ালের মত ধুর্ত হতে হয়। কুকুর তাড়ালে শিয়াল দৌঁড় দেয়, ধরা পড়ার পূর্বমুহূর্তে গন্ধ ছেড়ে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করে। এজন্য বগলে গন্ধ প্রয়োজন।
হুমায়ুন সাহেব বলে চলছেন: সরকারি চাকুরিতে অধিক মেধাবীরা অডম্যান। তারা কাকের দলে কোকিল।
জ্ঞানী হলে অসুবিধাটা কী? জানতে চান জগদীশ বাবু।
জ্ঞানীকে ট্যাকল করতে হলে অধিকতর জ্ঞানী হওয়া প্রয়োজন। তোমাকে ট্যাকল করতে হলে আমার তোমার চেয়ে অধিক মেধা প্রয়োজন, অতএব তুমি যাও। যে দেশে কাতেব-অজিরের মত লোক কমিশনার হন সে দেশের অফিসারদের বুঝতে তোমার বাকি থাকার কথা নয়।
জগদীশ চুপ
বগলতত্ত্ব অল্প সময়ে চারিদিকে ছড়িয়ে।
শুরু হয় বগল কেশ লম্বা করার প্রতিযোগিতা।
আগের বসকে খুশি করার জন্য যারা টুপি পড়তেন এখন তাদের মাথার টুপি উধাও।
টুপি ছেড়ে তারা বগল কেশের যত্নে নেমে পড়ে।
No comments:
Post a Comment