ভণ্ডামি
অনেক কষ্টে রাজশাহী থেকে উঠে আসতে পেরেছি। তাও মন্ত্রীর তদ্বিরে। চট্টগ্রামে যাদের বাড়ি তাদের জন্য রাজশাহী অনেক দূর। চাকুরি জীবনের প্রথম পদায়ন কাছাকাছি হওয়া উচিত, তখন শেকড় মুলের কাছাকাছি থাকে।
চাকুরির বয়স বাড়ার সাথে সাথে পিছুটান কমে যেতে থাকে।
তখন দূরে পোস্টিং দিলেও সমস্যা হয় না।
কচুর লতির মত শেকড়গুলো ছড়িয়ে পড়ে।
সংস্থাপন সচিবকে বলেছিলাম: স্যার আমি চট্টগ্রাম বদলি চাই। বাবা নেই। মা অসুস্থ।
তোমার বাড়ি চট্টগ্রাম। নিজ জেলায় পোস্টিং দিলে প্রভাবিত হবার সম্ভাবনা।
আমি সহকারী কমিশনার। আমাকে নিজ জেলায় পোস্টিং দিলে প্রভাবিত হব। তাহলে কমিশনার কীভাবে নিজ বিভাগে, প্রধান বিচারপতি, প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী কীভাবে নিজ দেশে দায়িত্ব পান?
মনের প্রশ্ন মনে রেখে দেই। সবসময় সত্য কথা বলা যায় না।
সংস্থাপন সচিব আমাকে বদলি করেননি।
তাই তদ্বির, তাই মন্ত্রী।
বাংলাদেশে তদ্বির ছাড়া প্রত্যাশিত কিছু পাওয়া দুষ্কর। ব্যতিক্রম আছে, Exception can not be Example.
কুমিল্লা যাবো। কুমিল্লা ভাল শহর। দুটি বিভাগীয় শহরের মাঝখানে। একদিকে ঢাকা, আরেকদিকে চাঁটগা।
ইচ্ছা হলে হবে না, মুরোদ চাই। কুমিল্লা বদলি হতেও তদ্বির লাগে।
আবার মন্ত্রী। একই গ্রামের লোক, তবে যোগাযোগ রাখতাম না। চাকরিতে মন্ত্রী প্রয়োজন, যোগত্যা ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা - এমনটি বুঝার পর মন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ শুরু করি।
সিনিয়রগণ এমন পরামর্শই দিয়েছেন।
এমন অভিজ্ঞতাই অর্জিত হচ্ছে প্রতিদিন।
মন্ত্রীর সামনে অনেক লোক।
আমাকে দেখে কাছে যাবার ইশার দিলেন।
এনি প্রবলেম?
আমি কুমিল্লা বদিল হব।
কুমিল্লা যাবে কেন? ঢাকায় থাকো।
কুমিল্লা বাড়ির কাছাকাছি। কমিশনারকে বলে দেন।
আগামীকাল কমিশনারের সাথে দেখা করো। বলে দেবো।
পরদিন কমিশনারের কাছে যাইনি। ক্ষমতাবান মন্ত্রীর তদ্বির, এক মাস পড়ে গেলেও হবে। তাড়াহুড়োর প্রয়োজন নেই।
ঢাকায় কয়েকদিন ঘুরলাম, দেখলাম। এমন সুযোগ সবসময় পাওয়া যায় না।
পাঁচ দিন পর কমিশনার সাহেবের কাছে যাই।
খুব নাকি কড়া লোক, এমন সুনাম শুনা যায়। বদনামও কম নয়।
সুনাম এবং বদনাম মল আর শরীরের মত অবিচ্ছেদ্য। দুটো থাকা চাই।
মলটাকে কে কত যত্নে গোপন রাখতে পারে তার উপর সুনামের প্রকাশ, বিস্তৃতি আর সৌন্দর্য্য নির্ভর করে।
মন্ত্রীর ভরসা নিয়ে সরাসরি কমিশনার সাহেবের কক্ষে ঢুকে পড়ি।
তার সামনে তিন জন ভদ্র লোক।
সালামের শব্দে কমিশনার সাহেব চোখ তুলেন।
কে আপনি?
বিনীতভঙ্গীতে বললাম: সহকারী কমিশনার।
দুহাতে চেয়ারের হাতল ধরে লাফিয়ে উঠেন তিনি। হিংস্র বাঘ, চোখেমুখে ক্রোধ। আমি ভয় পেয়ে যাই।
চিৎকারে দিয়ে উঠেন কমিশনার: কী বললে?
সহকারী কমিশনার।
তোর কোন্ সহকারী কমিশনার হয়ে কমিশনারের রুমে ঢুকে পড়লি। শালা বানচোত, কুত্তার বাচ্চা কুত্তা। তোর এমন সাহস হলো কী করে? বল্ তোর আইডি নাম্বর কতো। বলদের বাচ্চা বলদ, কোন্ শালা তোকে চাকরি দিয়েছে!
অল্প বয়স, নতুন চাকরি, এক বছরও হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ধ এখনও সারা শরীর ঘিরে।
কমিশনার সাহেবের অশালীন ব্যবহারে মেজাজ বিগড়ে।
মাথায় আগুন। শরীর কাঁপছে।
অপমানগুলো চড় হয়ে উঠতে চাইছে।
আমি আমাকে ভুলে যাই: আপনি এমন অশালীন আচরণ করছেন কেন?
এ বাঁন্দরের বাচ্চা বাঁন্দর, জানিস আমি কে?
এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসে এমন আচরণ, লজ্জা করে না আপনার?
আমার কথা শেষ হবার আগে প্রচণ্ড জোরে চীৎকার দিয়ে উঠেন: তোর নাম কি? বল্। দেখি কেমন করে তোর চাকরি থাকে। তোকে আমি পুলিশে দেব, তোর চাকুরি খাবো। হারামজাদা, শুধু তোর না, তোর বাপ দাদার চাকরিসহ খাবো। শালা, সহকারী কমিশনারের বাচ্চা সহকারী কমিশনার। বেয়াদবের বাচ্চা বেয়াদব!!
রাগে গড়গড় করতে করতে লোক তিনজনের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করেন: ফকিন্নির পোলারা চাকরিতে ঢুকে ক্যাডারের সর্বনাশ করে ছাড়ছে। খবর নিলে দেখবা শালার পুতের বাপ মেথর।
কী বললেন?
আমার চীৎকারে কিছুট ভড়কে যান কমিশনার: তোর নাম কী হারামজাদা?
শামীম।
নাম শুনে চমকে উঠেন কমিশনার: কী নাম বললে?
শামীম।
কমিশনার সাহেব চেয়ার ছেড়ে লাফ দেন। ভদ্র লাফ, আগের মত পাশবিক নয়।
ধীরপদে আমার মুখের সমানে এসে বুকের কাছাকাছি থামেন। তারপর,
তারপর আমার ডান হাতটা টেনে নিয়ে আদুরে গলায় বললেন: তোমার নাম শামীম!
জ্বী।
মন্ত্রী বাহাদুর পাঠিয়েছেন তো?
জ্বী।
হায়! হায়!! আগে বলবে না? আমি একদম বাজে হয়ে গেছি। বেয়াদব হয়ে গেছি। ইস্! নিজের বাপকে পর্যন্ত চিনতে পারছি না। নিজের গালে নিজেকে চড় দিতে ইচ্ছে করছে।
কমিশনার সাহেব দুহাত দিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।
আহা! যেন কলিজার টুকরো।
কানে কানে বললেন: এতক্ষণ কলজেটা জ্বলছিল। তোমার সাথে বুক লাগাতে পেরে বড় শান্তি পেলাম।
কোলাকোলি শেষ করে সামনে বসা ভদ্রলোকদের লক্ষ্য করে বললেন: আমার বাবা এসেছে। বসতে দে তাকে।
স্বল্প সময়ে এত অবিশ্বাস্য নাটকীয়তায় তিনজনই বিমূঢ়।
তারা কমিশনার সাহেবের সাথে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল। এখনও দাঁড়িয়ে।
কমিশনারের বাপ এসেছেন, আর থাকা যাবে না।
মলিনভাবে তিনজনই আমার দিকে তাকিয়ে, কমিশনারের বাপ এত কম বয়সের হয় কীভাবে!
তিনজনই বেড়িয়ে যান।
তারপর আসল নাটক।
কমিশনার সাহেব আমার ডান হাত টেনে নিয়ে নতুন প্রেমিকের মতো আঙ্গুল টিপছেন।
বড় আরাম, বড় নরম, অতীতে আর পাইনি।
বাবা শামীম আমি কিন্তু আপন ভেবে তোমার সাথে এমন ব্যবহার করেছি। তোমাকে পরীক্ষা করেছি। অফিসার হবার যোগ্যতা আছে কিনা। দেখলাম, তোমাতে আগুন আছে, জেদ আছে। তুমি অনেক বড় হবে। বুঝলে?
বুঝলাম।
মন্ত্রী মহোদয়কে এসব কিছু বলিও না।
একজন কমিশনারের এমন আচরণে আমার মন চাকরির প্রতি বিষিয়ে।
ছি! এমন লোকের অধিনে চাকরি করতে হবে!!
তাকে প্রথম দেখেছিলাম কলেজিয়েট স্কুলের মাঠে।
দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মাহফিলে সভাপতিত্ব করছিলেন। তখন তিনি জেলাপ্রশাসক, আমি ছাত্র।
তিনি সিএসপি,
তিনি ধার্মিক;
তিনি স্বনামধন্য।
তিনি সাঈদীর মাহফিলে সভাপতিত্ব করেন।
অনেক সুনাম-
গভীরভাবে কমিশনার সাহেবকে লক্ষ্য করছি-
শ্যামলা, খাটো কিন্তু চ্যাপ্টা, মোটা পেট, ছোট ছোট দাড়ি বড় হবার অপেক্ষায়, রুক্ষ চেহারায় হিংস্রতার ঝড়;
চোখে অহঙ্কারের পুকুর, অন্তরে অতৃপ্তির সাগর।
সাধারণ্যে তিনি সৎ এবং ধার্মিক।
তবে ভুক্তভোগীদের কাছে জঘন্য।
তিনি শাক্ত,
স্বজনপ্রীতি এবং ক্ষমতা-তোষণে দক্ষ।
অন্যান্য সিএসপিদের মতো তিনিও পাম্প দিলে বলের মত লাথি খাবার উপযুক্ততা অর্জনের জন্য ফুলে যান।
বাবা, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছো তো।
কীসের ক্ষমা! কমিশনারের প্রশ্নের পিঠে আমি প্রশ্ন ছড়িয়ে দেই। আর বিনয়ী থাকার প্রশ্নই আসে না।
মন্ত্রীকে কিন্তু কিছু বলবে না। বলবে না তো?
ন্যাকামি দেখে হাসি চেপে রাখা গেল না। হেসে দেই, হাসি নাকি রাগের মরণ।
বলবো না।
খুশী হলাম, বড় খুশি হলাম। কী খাবে?
কলিং বিলে টিপ দেন কমিশনার। পিয়ন দরজা খুলে।
আমার বাপের জন্য ফান্টা, কেক, পরোটা আর মাংস নিয়ে এসো।
আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।
কুমিল্লা যাবে তো?
আমি কোথায় যাবো মন্ত্রী আপনাকে বলেননি?
বলেছেন, বলেছেন; কুমিল্লা। এক্ষুণি আদেশ করে দিচ্ছি। বাপ, রাগ করিস না। আমার ভয় হয়, হার্টের রোগি।
কুমিল্লা যাবার আগে কমিশনার সাহেবের সাথে দেখা করতে যাই। আমার ছেলে।
বাপ, কী খাবে?
কুমিল্লা কোথায় থাকবো?
জেলাপ্রশাসককে টেলিফোন করেন: আমার বাপ যাচ্ছে, খেয়াল রেখো। সে সার্কিট হাউজে থাকবে। ব্যাচেলর মানুষ।
কয়েক মাস পরের ঘটনা।
রাত অনুমান এগারটা, আমার রুমের দরজায় টক টক।
সার্কিট হাউজের পিয়ন।
কী ব্যাপার?
আগের কমিশনার স্যার এসেছেন।
কোথায়?
গেস্ট রুমে। আপনাকে সালাম দিয়েছেন।
পাঠক, পূর্ব বর্ণিত কমিশনার এখন প্রাক্তন। সপ্তাহ খানেক আগে বদলি হয়ে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। একটা কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান। কয়েক ঘণ্টা আগে বর্তমান কমিশনার শফিক সাহেব এসেছেন।
তিনি ভিআইপি এক নম্বর কক্ষে আছেন।
প্রাক্তন কমিশনার আমাকে দেখে বললেন: কেমন আছো বাপ?
ভালো।
এনডিসিকে রিং করেছি, সে আসছে। চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম, প্রচণ্ড যানজট। রাতটা এখানে থেকে যাবো।
কিছুক্ষণ পর এনডিসি আসেন, চোখে ঘুমের ধুম, পিট পিট করে তাকাচ্ছেন।
প্রাক্তন কমিশনার: ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে প্রচণ্ড যানজট, কোথায় নাকি গাড়ি উল্টে গেছে। ভিআইপি ওয়ান কক্ষটা দাও।
এনডিসি বিনীতভাবে বললেন: স্যার, নতুন কমিশনার ভি.আইপি ওয়ানে। ভিআইপি টু খালি আছে।
আমি ভিআইপি টুতে থাকব না। ভিআইপি ওয়ান দেবে।
স্যার, একটু অপেক্ষা করুন।
অপেক্ষা করতে পারব না। এক্ষুণি দাও। আমিই তোমাকে এখানে পদায়ন করেছি। নিমক হারামি করো না।
বিপদে পড়ে যান এনডিসি।
বিগলিত স্বরে বললেন: কমিশনার স্যার ঘুমিয়ে পড়েছেন। আপনি ভিআইপি টুতে রেস্ট নিন, ততক্ষণে স্যারকে ডেকে তুলছি।
আমি এক সেকেন্ডের জন্যও ভিআইপি টুতে উঠবো না। ভিআইপি ওয়ানে যে আছে সে আমার জুনিয়র।
ভিআইপি ওয়ানই দেবো স্যার। কমিশনার মহোদয়কে এত রাতে জাগানো কী ঠিক হবে? কাল সকালে - - -
তাকে তুমি বের করে দাও।
এটা কী স্যার উচিত হবে?
তুমি আমাকে ভিআইপি ওয়ান দিতে পারবে না। তোমার মুরোদ আমার জানা হয়ে গেছে। আমি এক নম্বর মানুষ, কোনো দিন দুই নম্বর কক্ষে থাকিনি। জুনিয়র হয়ে সে থাকবে ওয়ানে আর আমি টুতে, এমন হতে পারে না। এক জঙ্গলে দুই বাঘের বাস অসম্ভব। চললাম, পেশ্রাব করি তোর সার্কিট হাউজে।
আমি বললাম: সার্কিট হাউস ব্যবহার বিধি অনুযায়ী বর্তমান কমিশনার ভিআইপি ওয়ান পান। আপনি নন।
বাপ, তুমি বলে বেঁচে গেলে। আমি বিধিপিধি বুঝি না। সোজা কথা আমি থাকবো না। রাস্তায় কিছু হলে দায়িত্ব এনডিসিকে নিতে হবে। তুমি সাক্ষি রইলে বাপ।
প্রাক্তন কমিশনারের গাড়ি বেরিয়ে যেতে এনডিসি হেসে উঠেন: পাগল, আস্ত পাগল।
মনে মনে বললাম: পেছনে পাগল সামনে বাপ, দুরে গেলে লাথি সামনে এলে লাফ।
মন্তব্য: বর্ণিত ঘটনাদ্বয়ের নায়ক সবসময় নিজেকে সৎ বলে প্রচার করতেন। তার দাবি তিনি নির্লোভ। শুধু নিজের অন্ধ অহমিকার বশে সম-সুযোগ সম্পন্ন কক্ষ থাকা সত্ত্বেও রাত এগারটায় যিনি অন্য একজন সহকর্মীকে কক্ষ হতে বিধি উপেক্ষা করে করে দেয়ার প্রস্তাব দিতে পারেন তিনি কোন্ ধরনের সৎ আমি জানি না। অহংবোধে অন্ধ মানুষ কখনো সৎ হতে পারে না। অহংকার মানুষের সমস্ত মানবিক গুণাবলী ধ্বংস করে দেয়, ভণ্ড বানিয়ে ছাড়ে।
[পুনশ্চ: আমার একজন সিনিয়র ও শ্রদ্ধাষ্পদ সহকর্মীর পরামর্শের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কমিশনার সাহেবের নাম উহ্য রাখলাম। তবে তিনি কে তা চিনতে অনেকের কষ্ট হবে না। কারণ এমন ঘটনা কে করতে পারেন তা অনেকে জানেন।]
অনেক কষ্টে রাজশাহী থেকে উঠে আসতে পেরেছি। তাও মন্ত্রীর তদ্বিরে। চট্টগ্রামে যাদের বাড়ি তাদের জন্য রাজশাহী অনেক দূর। চাকুরি জীবনের প্রথম পদায়ন কাছাকাছি হওয়া উচিত, তখন শেকড় মুলের কাছাকাছি থাকে।
চাকুরির বয়স বাড়ার সাথে সাথে পিছুটান কমে যেতে থাকে।
তখন দূরে পোস্টিং দিলেও সমস্যা হয় না।
কচুর লতির মত শেকড়গুলো ছড়িয়ে পড়ে।
সংস্থাপন সচিবকে বলেছিলাম: স্যার আমি চট্টগ্রাম বদলি চাই। বাবা নেই। মা অসুস্থ।
তোমার বাড়ি চট্টগ্রাম। নিজ জেলায় পোস্টিং দিলে প্রভাবিত হবার সম্ভাবনা।
আমি সহকারী কমিশনার। আমাকে নিজ জেলায় পোস্টিং দিলে প্রভাবিত হব। তাহলে কমিশনার কীভাবে নিজ বিভাগে, প্রধান বিচারপতি, প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী কীভাবে নিজ দেশে দায়িত্ব পান?
মনের প্রশ্ন মনে রেখে দেই। সবসময় সত্য কথা বলা যায় না।
সংস্থাপন সচিব আমাকে বদলি করেননি।
তাই তদ্বির, তাই মন্ত্রী।
বাংলাদেশে তদ্বির ছাড়া প্রত্যাশিত কিছু পাওয়া দুষ্কর। ব্যতিক্রম আছে, Exception can not be Example.
কুমিল্লা যাবো। কুমিল্লা ভাল শহর। দুটি বিভাগীয় শহরের মাঝখানে। একদিকে ঢাকা, আরেকদিকে চাঁটগা।
ইচ্ছা হলে হবে না, মুরোদ চাই। কুমিল্লা বদলি হতেও তদ্বির লাগে।
আবার মন্ত্রী। একই গ্রামের লোক, তবে যোগাযোগ রাখতাম না। চাকরিতে মন্ত্রী প্রয়োজন, যোগত্যা ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা - এমনটি বুঝার পর মন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ শুরু করি।
সিনিয়রগণ এমন পরামর্শই দিয়েছেন।
এমন অভিজ্ঞতাই অর্জিত হচ্ছে প্রতিদিন।
মন্ত্রীর সামনে অনেক লোক।
আমাকে দেখে কাছে যাবার ইশার দিলেন।
এনি প্রবলেম?
আমি কুমিল্লা বদিল হব।
কুমিল্লা যাবে কেন? ঢাকায় থাকো।
কুমিল্লা বাড়ির কাছাকাছি। কমিশনারকে বলে দেন।
আগামীকাল কমিশনারের সাথে দেখা করো। বলে দেবো।
পরদিন কমিশনারের কাছে যাইনি। ক্ষমতাবান মন্ত্রীর তদ্বির, এক মাস পড়ে গেলেও হবে। তাড়াহুড়োর প্রয়োজন নেই।
ঢাকায় কয়েকদিন ঘুরলাম, দেখলাম। এমন সুযোগ সবসময় পাওয়া যায় না।
পাঁচ দিন পর কমিশনার সাহেবের কাছে যাই।
খুব নাকি কড়া লোক, এমন সুনাম শুনা যায়। বদনামও কম নয়।
সুনাম এবং বদনাম মল আর শরীরের মত অবিচ্ছেদ্য। দুটো থাকা চাই।
মলটাকে কে কত যত্নে গোপন রাখতে পারে তার উপর সুনামের প্রকাশ, বিস্তৃতি আর সৌন্দর্য্য নির্ভর করে।
মন্ত্রীর ভরসা নিয়ে সরাসরি কমিশনার সাহেবের কক্ষে ঢুকে পড়ি।
তার সামনে তিন জন ভদ্র লোক।
সালামের শব্দে কমিশনার সাহেব চোখ তুলেন।
কে আপনি?
বিনীতভঙ্গীতে বললাম: সহকারী কমিশনার।
দুহাতে চেয়ারের হাতল ধরে লাফিয়ে উঠেন তিনি। হিংস্র বাঘ, চোখেমুখে ক্রোধ। আমি ভয় পেয়ে যাই।
চিৎকারে দিয়ে উঠেন কমিশনার: কী বললে?
সহকারী কমিশনার।
তোর কোন্ সহকারী কমিশনার হয়ে কমিশনারের রুমে ঢুকে পড়লি। শালা বানচোত, কুত্তার বাচ্চা কুত্তা। তোর এমন সাহস হলো কী করে? বল্ তোর আইডি নাম্বর কতো। বলদের বাচ্চা বলদ, কোন্ শালা তোকে চাকরি দিয়েছে!
অল্প বয়স, নতুন চাকরি, এক বছরও হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ধ এখনও সারা শরীর ঘিরে।
কমিশনার সাহেবের অশালীন ব্যবহারে মেজাজ বিগড়ে।
মাথায় আগুন। শরীর কাঁপছে।
অপমানগুলো চড় হয়ে উঠতে চাইছে।
আমি আমাকে ভুলে যাই: আপনি এমন অশালীন আচরণ করছেন কেন?
এ বাঁন্দরের বাচ্চা বাঁন্দর, জানিস আমি কে?
এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসে এমন আচরণ, লজ্জা করে না আপনার?
আমার কথা শেষ হবার আগে প্রচণ্ড জোরে চীৎকার দিয়ে উঠেন: তোর নাম কি? বল্। দেখি কেমন করে তোর চাকরি থাকে। তোকে আমি পুলিশে দেব, তোর চাকুরি খাবো। হারামজাদা, শুধু তোর না, তোর বাপ দাদার চাকরিসহ খাবো। শালা, সহকারী কমিশনারের বাচ্চা সহকারী কমিশনার। বেয়াদবের বাচ্চা বেয়াদব!!
রাগে গড়গড় করতে করতে লোক তিনজনের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করেন: ফকিন্নির পোলারা চাকরিতে ঢুকে ক্যাডারের সর্বনাশ করে ছাড়ছে। খবর নিলে দেখবা শালার পুতের বাপ মেথর।
কী বললেন?
আমার চীৎকারে কিছুট ভড়কে যান কমিশনার: তোর নাম কী হারামজাদা?
শামীম।
নাম শুনে চমকে উঠেন কমিশনার: কী নাম বললে?
শামীম।
কমিশনার সাহেব চেয়ার ছেড়ে লাফ দেন। ভদ্র লাফ, আগের মত পাশবিক নয়।
ধীরপদে আমার মুখের সমানে এসে বুকের কাছাকাছি থামেন। তারপর,
তারপর আমার ডান হাতটা টেনে নিয়ে আদুরে গলায় বললেন: তোমার নাম শামীম!
জ্বী।
মন্ত্রী বাহাদুর পাঠিয়েছেন তো?
জ্বী।
হায়! হায়!! আগে বলবে না? আমি একদম বাজে হয়ে গেছি। বেয়াদব হয়ে গেছি। ইস্! নিজের বাপকে পর্যন্ত চিনতে পারছি না। নিজের গালে নিজেকে চড় দিতে ইচ্ছে করছে।
কমিশনার সাহেব দুহাত দিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।
আহা! যেন কলিজার টুকরো।
কানে কানে বললেন: এতক্ষণ কলজেটা জ্বলছিল। তোমার সাথে বুক লাগাতে পেরে বড় শান্তি পেলাম।
কোলাকোলি শেষ করে সামনে বসা ভদ্রলোকদের লক্ষ্য করে বললেন: আমার বাবা এসেছে। বসতে দে তাকে।
স্বল্প সময়ে এত অবিশ্বাস্য নাটকীয়তায় তিনজনই বিমূঢ়।
তারা কমিশনার সাহেবের সাথে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল। এখনও দাঁড়িয়ে।
কমিশনারের বাপ এসেছেন, আর থাকা যাবে না।
মলিনভাবে তিনজনই আমার দিকে তাকিয়ে, কমিশনারের বাপ এত কম বয়সের হয় কীভাবে!
তিনজনই বেড়িয়ে যান।
তারপর আসল নাটক।
কমিশনার সাহেব আমার ডান হাত টেনে নিয়ে নতুন প্রেমিকের মতো আঙ্গুল টিপছেন।
বড় আরাম, বড় নরম, অতীতে আর পাইনি।
বাবা শামীম আমি কিন্তু আপন ভেবে তোমার সাথে এমন ব্যবহার করেছি। তোমাকে পরীক্ষা করেছি। অফিসার হবার যোগ্যতা আছে কিনা। দেখলাম, তোমাতে আগুন আছে, জেদ আছে। তুমি অনেক বড় হবে। বুঝলে?
বুঝলাম।
মন্ত্রী মহোদয়কে এসব কিছু বলিও না।
একজন কমিশনারের এমন আচরণে আমার মন চাকরির প্রতি বিষিয়ে।
ছি! এমন লোকের অধিনে চাকরি করতে হবে!!
তাকে প্রথম দেখেছিলাম কলেজিয়েট স্কুলের মাঠে।
দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মাহফিলে সভাপতিত্ব করছিলেন। তখন তিনি জেলাপ্রশাসক, আমি ছাত্র।
তিনি সিএসপি,
তিনি ধার্মিক;
তিনি স্বনামধন্য।
তিনি সাঈদীর মাহফিলে সভাপতিত্ব করেন।
অনেক সুনাম-
গভীরভাবে কমিশনার সাহেবকে লক্ষ্য করছি-
শ্যামলা, খাটো কিন্তু চ্যাপ্টা, মোটা পেট, ছোট ছোট দাড়ি বড় হবার অপেক্ষায়, রুক্ষ চেহারায় হিংস্রতার ঝড়;
চোখে অহঙ্কারের পুকুর, অন্তরে অতৃপ্তির সাগর।
সাধারণ্যে তিনি সৎ এবং ধার্মিক।
তবে ভুক্তভোগীদের কাছে জঘন্য।
তিনি শাক্ত,
স্বজনপ্রীতি এবং ক্ষমতা-তোষণে দক্ষ।
অন্যান্য সিএসপিদের মতো তিনিও পাম্প দিলে বলের মত লাথি খাবার উপযুক্ততা অর্জনের জন্য ফুলে যান।
বাবা, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছো তো।
কীসের ক্ষমা! কমিশনারের প্রশ্নের পিঠে আমি প্রশ্ন ছড়িয়ে দেই। আর বিনয়ী থাকার প্রশ্নই আসে না।
মন্ত্রীকে কিন্তু কিছু বলবে না। বলবে না তো?
ন্যাকামি দেখে হাসি চেপে রাখা গেল না। হেসে দেই, হাসি নাকি রাগের মরণ।
বলবো না।
খুশী হলাম, বড় খুশি হলাম। কী খাবে?
কলিং বিলে টিপ দেন কমিশনার। পিয়ন দরজা খুলে।
আমার বাপের জন্য ফান্টা, কেক, পরোটা আর মাংস নিয়ে এসো।
আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।
কুমিল্লা যাবে তো?
আমি কোথায় যাবো মন্ত্রী আপনাকে বলেননি?
বলেছেন, বলেছেন; কুমিল্লা। এক্ষুণি আদেশ করে দিচ্ছি। বাপ, রাগ করিস না। আমার ভয় হয়, হার্টের রোগি।
কুমিল্লা যাবার আগে কমিশনার সাহেবের সাথে দেখা করতে যাই। আমার ছেলে।
বাপ, কী খাবে?
কুমিল্লা কোথায় থাকবো?
জেলাপ্রশাসককে টেলিফোন করেন: আমার বাপ যাচ্ছে, খেয়াল রেখো। সে সার্কিট হাউজে থাকবে। ব্যাচেলর মানুষ।
কয়েক মাস পরের ঘটনা।
রাত অনুমান এগারটা, আমার রুমের দরজায় টক টক।
সার্কিট হাউজের পিয়ন।
কী ব্যাপার?
আগের কমিশনার স্যার এসেছেন।
কোথায়?
গেস্ট রুমে। আপনাকে সালাম দিয়েছেন।
পাঠক, পূর্ব বর্ণিত কমিশনার এখন প্রাক্তন। সপ্তাহ খানেক আগে বদলি হয়ে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। একটা কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান। কয়েক ঘণ্টা আগে বর্তমান কমিশনার শফিক সাহেব এসেছেন।
তিনি ভিআইপি এক নম্বর কক্ষে আছেন।
প্রাক্তন কমিশনার আমাকে দেখে বললেন: কেমন আছো বাপ?
ভালো।
এনডিসিকে রিং করেছি, সে আসছে। চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম, প্রচণ্ড যানজট। রাতটা এখানে থেকে যাবো।
কিছুক্ষণ পর এনডিসি আসেন, চোখে ঘুমের ধুম, পিট পিট করে তাকাচ্ছেন।
প্রাক্তন কমিশনার: ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে প্রচণ্ড যানজট, কোথায় নাকি গাড়ি উল্টে গেছে। ভিআইপি ওয়ান কক্ষটা দাও।
এনডিসি বিনীতভাবে বললেন: স্যার, নতুন কমিশনার ভি.আইপি ওয়ানে। ভিআইপি টু খালি আছে।
আমি ভিআইপি টুতে থাকব না। ভিআইপি ওয়ান দেবে।
স্যার, একটু অপেক্ষা করুন।
অপেক্ষা করতে পারব না। এক্ষুণি দাও। আমিই তোমাকে এখানে পদায়ন করেছি। নিমক হারামি করো না।
বিপদে পড়ে যান এনডিসি।
বিগলিত স্বরে বললেন: কমিশনার স্যার ঘুমিয়ে পড়েছেন। আপনি ভিআইপি টুতে রেস্ট নিন, ততক্ষণে স্যারকে ডেকে তুলছি।
আমি এক সেকেন্ডের জন্যও ভিআইপি টুতে উঠবো না। ভিআইপি ওয়ানে যে আছে সে আমার জুনিয়র।
ভিআইপি ওয়ানই দেবো স্যার। কমিশনার মহোদয়কে এত রাতে জাগানো কী ঠিক হবে? কাল সকালে - - -
তাকে তুমি বের করে দাও।
এটা কী স্যার উচিত হবে?
তুমি আমাকে ভিআইপি ওয়ান দিতে পারবে না। তোমার মুরোদ আমার জানা হয়ে গেছে। আমি এক নম্বর মানুষ, কোনো দিন দুই নম্বর কক্ষে থাকিনি। জুনিয়র হয়ে সে থাকবে ওয়ানে আর আমি টুতে, এমন হতে পারে না। এক জঙ্গলে দুই বাঘের বাস অসম্ভব। চললাম, পেশ্রাব করি তোর সার্কিট হাউজে।
আমি বললাম: সার্কিট হাউস ব্যবহার বিধি অনুযায়ী বর্তমান কমিশনার ভিআইপি ওয়ান পান। আপনি নন।
বাপ, তুমি বলে বেঁচে গেলে। আমি বিধিপিধি বুঝি না। সোজা কথা আমি থাকবো না। রাস্তায় কিছু হলে দায়িত্ব এনডিসিকে নিতে হবে। তুমি সাক্ষি রইলে বাপ।
প্রাক্তন কমিশনারের গাড়ি বেরিয়ে যেতে এনডিসি হেসে উঠেন: পাগল, আস্ত পাগল।
মনে মনে বললাম: পেছনে পাগল সামনে বাপ, দুরে গেলে লাথি সামনে এলে লাফ।
মন্তব্য: বর্ণিত ঘটনাদ্বয়ের নায়ক সবসময় নিজেকে সৎ বলে প্রচার করতেন। তার দাবি তিনি নির্লোভ। শুধু নিজের অন্ধ অহমিকার বশে সম-সুযোগ সম্পন্ন কক্ষ থাকা সত্ত্বেও রাত এগারটায় যিনি অন্য একজন সহকর্মীকে কক্ষ হতে বিধি উপেক্ষা করে করে দেয়ার প্রস্তাব দিতে পারেন তিনি কোন্ ধরনের সৎ আমি জানি না। অহংবোধে অন্ধ মানুষ কখনো সৎ হতে পারে না। অহংকার মানুষের সমস্ত মানবিক গুণাবলী ধ্বংস করে দেয়, ভণ্ড বানিয়ে ছাড়ে।
[পুনশ্চ: আমার একজন সিনিয়র ও শ্রদ্ধাষ্পদ সহকর্মীর পরামর্শের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কমিশনার সাহেবের নাম উহ্য রাখলাম। তবে তিনি কে তা চিনতে অনেকের কষ্ট হবে না। কারণ এমন ঘটনা কে করতে পারেন তা অনেকে জানেন।]
No comments:
Post a Comment