Translate

Sunday, 26 July 2015

ছি / ড. মোহাম্মদ আমীন

ছি
=
আমার মায়ের বয়স যখন ছয় মাস তখন আমার নানি মারা যান।
নানি মারা যাবার দুই মাস পর নানা আবার বিয়ে করেন।
নানার দ্বিতীয় বউ ছিল খুব ফুটফুটে। সবাই ডাকত ফুটফুটি। চার ছেলে ও এক মেয়ে জন্ম দেয়ার পর ফুটফুটি নানি রোগে আক্রান্ত হন।
মায়ের বিয়ে হয় কম বয়সে। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়ার ইচ্ছা নানার ছিল না কিন্তু সৎ মায়ের অত্যাচার হতে কন্যাকে রেহাই দেয়ার জন্য বিয়ে ছাড়া অন্য বিকল্পও ছিল না।
ফুটফুটি নানির রোগ দিন দিন বেড়ে চলে।
কয়েক মাসের মধ্যে তিনি চলৎ শক্তি হারিয়ে ফেলেন।
মূল বাড়ি হতে বিচ্ছিন্ন একটি বেড়ার ঘরে মাটির মেঝে ফুটফুটি নানী গু-মুতের উপর শুয়ে থাকতেন। মাথার সামনে একটা ভাঙ্গা থালা। ওটাতে ভাত-তরকারি, পানি খেতে দেয়া হতো। গন্ধে খালা-মামারা ওই বাড়ির কাছে ঘেষতেন না। মামাদের দেখলে কাছে ডাকতেন। কেউ যেতো না। আট হাত লম্বা বাঁশের মাথায় থালা বেঁধে কাজের বুয়া জরিনা আচল দিয়ে নাকমুখ ঢেকে ফুটফুটি নানির ঘরের থালায় ভাত ঢেলে দিত। জরিনার হাতে বাঁশ দেখলে ফুটফুটি নানির চোখেমুখে একটা হাসি খেলে যেতো। এত কষ্টময় জীবন, তবু বেঁচে থাকার কী আনন্দ!
ফুটফুটী নানির অসুখের অজুহতে নানা মামাদের কাছ থেকে আবার বিয়ের সম্মতি আদায় করে নেয়।
আমি নানার প্রথম নাতি। বড় মেয়ের ছেলে হিসেবে আমার প্রতি ছিলেন অসম্ভব দুর্বল। আমি ছিলাম নানার প্রথম ভালবাসা, দ্বিতীয় হুকো। সারাদিন তিনি হুকো টানতেন। বাজারে যাবার সময়ও হুকো থাকতো হাতে।
একদিন নানা আদুরে গলায় বললেন: চৌদোলায় চড়েছিস?
না।
বিমানে?
দাদুর সাথে করাচি। খুব মজা। নিচে তাকালে সব খেলনা মনে হয়।
চৌদোলায় চড়া বিমানের চেয়েও মজা।
সত্যি?
যারা হুকো টানে তারা মিথ্যা বলে না।
আমি চৌদোলায় চড়ার লোভে হুকোর মাথায় কল্কে পরিয়ে নানার কোলে বসে পড়ি। নানা আমাকে জড়িয়ে ধরে মুখে চুমো দেয়। মুখ তামাকের গন্ধে ভরা। খারাপ লাগে না। অমন চুমো প্রতিদিন খাই। অভ্যেস হয়ে গেছে।
নানার চুমো আমার সিগারেটের প্রথম কাহিনী।
সত্যি আমাকে চৌদোলায় চড়াবে?
চড়াব মানে? অবশ্যই চড়াবো।
কখন?
বিয়ে ছাড়া চৌদলায় চড়া যায় না। শরিয়তের নিষেধ আছে।
শরিয়ত কে?
শরিয়ত কোন মানুষ নয়। ইসলামের কথা। তোর দাদুর কাছে জিজ্ঞাসা করিস। কামেল মানুষ; তিনি ভালো জানেন।
ইসলাম কে?
আরে নানু, ইসলাম হচ্ছে ধর্ম।
নানা আমাকে শেরওয়ানি কিনে দিয়েছিল, শেরওয়ানির সাথে প্যান্ট। দুটোই ঢিলে হয়েছে। শেরওয়ানি কোন রকমে মানিয়ে গেলেও প্যান্ট কোমড়ের চেয়ে ঢের বড়। মা চেষ্টা করছিল বেল্ট দিয়ে বেঁধে দিতে। আমরা তখন বেল্ট ছাড়া হাফ ফ্যান্ট পড়তাম, দরজি কোমড় ঠিক করে বানিয়ে দিত।
নানা বলল: প্যন্ট টাইট করা লাগবে না। সে তো আর হাটছে না। আমার কোলের উপর বসে থাকবে।
মা বলল: যদি বিয়ে বাড়ি দেখতে চায়?
বশর মামা বলল: আমি কোলে করে নিয়ে যাব।
বিয়ের দিন নানাও শেরওয়ানি পড়েছিল। কেনা নয়, ভাড়া। বিয়ের সময় শেরওয়ানি ভাড়া করে আনা হত।
বিয়ের দিন সকাল হতে শেরওয়ানি গায়ে দিয়ে বরযাত্রার অপেক্ষা করছিলাম। নিজেকে দুলহান-দুলহান মনে হচ্ছিল। চৌদোলা সাজানো হয়ে গেছে। নানা সেরওয়ানি পরে প্রস্তুত। কলসি ভরা পানিতে আমের ডাল ঢুকিয়ে নানার ভাবিরা জল ছেটানোর অপেক্ষায়।
আমি সেরওয়ানির ভাঁজগুলো ঠিক আছে কিনা দেখে হাত দিয়ে প্যান্টটা চেপে ধরে ধীরপদে চৌদোলায় গিয়ে বসে পড়ি।
পাঁচ মিনিট পড়ে আসেন নানা।
আল্লাহু আকবর বলে বাহকরা চৌদোলা কাঁধে তুলে নেয়।
নানা উসখুস করছিল। শেরওয়ানি ও পাগড়ি উসখুসের কারণ। নানার নতুন শ্বশড় বাড়ি শোভনদণ্ডি। কম হলে চার কিলো। এতটুক পথ চৌদোলায় যেতে পারব। আমি তালি দিয়ে উঠি।
কয়েক শ গজ আসার পর নানা পাগড়ি খুলে আমার মাথায় পড়িয়ে দেয়।
পাগড়ি আমার গলা পর্যন্ত ঢেকে। কিছুক্ষণ পর আমারও চুলকাতে শুরু করে, মাথা নয় গলা। তবু নামাই না, পাগড়ি পড়ার শখ বহুদিনের, চুলকালেও বেশ লাগছে। আয়না থাকলে দেখে নিতাম।
মনে হচ্ছিল নানা নয়, আমিই বিয়ে করতে যাচ্ছি।
চৌদালায় দুলতে দুলতে কিছুক্ষণের মধ্যে স্বভাবকবি নানা আবিদুর রহমানের ঘুম এসে যায়।
হুকোর নলটা হাত থেকে পড়ে, আস্তে করে মুখে লাগাই। এ প্রথম মুখ দিয়ে ধোঁয়া ঢুকে শরীরে। মগজটা শির শির করে উঠে। কাশি আসার চেষ্টা করছিল। চেপে রাখি, নানার ঘুম ভেঙ্গে গেলে ভেঞ্চারটা মাটি হয়ে যাবে। তামাকের ধোঁয়া খারাপ লাগে না। শরীরটা কাঁপছে। কেউ টের পায়নি তো! নানার দিকে তাকাই।
নানা ঘুমিয়ে।
বুড়ো বরগণ শুধু ঘুমায়।
বিয়ের বাড়ির বাজনা শুনা যাচ্ছে।
চৌদোলা মাটিতে বসানোর সাথে সাথে আমি পাগড়িসহ নিচে নেমে আসি।
চারিদিকে লোক। আমি উদ্বেল।
চৌদোলা হতে একটা বালক নেমে আসতে দেখে চারিদিকে হাসির রোল। আমার কোনদিকে খেয়াল নেই।
হবু নানীর মহিলা বান্ধবীরা আমাকে ঘিরে ধরে:
বর এসেছে বর,
পালিয়ে যাবে ধর।
এক মহিলা আমাকে কোলে নিয়ে চুমোতে শুরু করে। মুখে দুর্গন্ধ। লাফ দিয়ে নেমে ভো দৌঁড়। কে একজন কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে উঠে:
ছোট্ট বরের নরম তনু,
হাতিয়ে দেখি ঘুমিয়ে নুনু।
একটু ধরে লাগাও নাড়া
দেখবে কেমন হয় সে খাড়া।।
আমি ভয় পেয়ে যাই। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে।
কী হয়েছে?
অবাক হয়ে দেখি আমার ঘিয়ে রঙের প্যান্টটা এক মহিলার হাতে।
কী করি?
প্যান্ট আনতে দৌঁড় দেয়ার আগে নানা চৌদোলা হতে নেমে আমাকে টেনে নিয়ে আবার চৌদোলায় ঢুকে যায়।
নানা : তোর প্যান্ট কয়?
ভয়ে ভয়ে বাইরে তাকাই: ঐ যে।
ওখানে কীভাবে গেল?
জানি না।
আমার চোখে জল, মুখে লজ্জা, বুকে রাগ-
ছি!

No comments:

Post a Comment