Translate

Sunday, 26 July 2015

প্রথম প্রেম/ ড. মোহাম্মদ আমীন

প্রথম প্রেম

উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর শরীরটা কেমন জানি বোয়াল মাছের মতো লাফাতে শুরু করে। প্রথম দিনই সহপাঠী তাহেরা আলোড়ন তুলে। সে সময় প্রেম ছিল ঘৃণার, সাংঘাতিক জঘন্য। চুরি-ডাকাতির মত লজ্জাকর। ক্লাশে অনেক সুন্দরি মেয়ে থাকলেও দৈহিক গড়নের জন্য আমাকে তাহেরার প্রেমে পড়তে হয়। সে ছাড়া অন্য মেয়েরা ছিল কাতাল মাছের মত চ্যাপ্টা, নাদুসনুদস; পেটগুলো পাঙ্গাস মাছের মত চর্বি-টুম্বর।
ছাত্রীরা টিচারের পেছনে পেছনে ক্লাশে আসত। ক্লাশ শেষে আবার চলে যেত।
আকতার বলতো: ছাত্রীরা মুরগির বাচ্চা, আমরা শেয়াল। যার পেছনে ছাত্রীরা আসেন তিনি কুকুর। শেয়াল মুরগির বাচ্চা খেয়ে ফেলবে তাই কুকুর পাহারা।
ছাত্রীদের সাথে কথা বলা যেতো না। ভালভাবে তাকানোও ছিল অপরাধ। চিন্তাভাবনা করে তাহেরার প্রেমে পড়েছি। তবে এক বাক্য কথা বলার সুযোগ হয়নি। অভিসার শব্দটাকে কত বার কতভাবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছি। পোঁড়া কপাল সম্ভব হয়নি। বালিকারা সুন্দরী কিন্তু অধরা। স্কুল কম্পাউন্ডে কোন ছাত্রীর সাথে কথা বলার সুযোগ ছিল না। সুযোগ নিলে পথে নিতে হতো। তাহেরা আর আমার আসা-যাওয়ার পথ ছিল ভিন্ন- দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে বেঁকে।
আমার প্রেম ছিল প্লাটোনিক। দূর হতে কায়া দেখে মায়া নিতাম। উদাস সুখে শিউরে উঠতাম কাঁপুনে ভালবাসার বায়বীয় রোমাঞ্চে। মোবাইল নামের যন্ত্রটা কল্পনাতেও ছিল না। চিঠিই একমাত্র ভরসা। কিন্তু কীভাবে চিঠি দেই? যদি প্রত্যাখ্যান করে; অভিযোগ জানায়?
কী হবে তখন?
ভয়ে প্রেম মন মড়া কেচোর মতো কুঁচকে যেতো।
তাহেরা সামনের টুলে উত্তর কোণে বসতো। প্রতিদিন না হলেও প্রায় সময়। অনেকদিন গবেষণা করে এটা আবিষ্কার করেছি। একদিন সবার আগে স্কুলে আসি। কেউ নেই। আমি চোরের মতো এদিক ওদিক তাকাই। তারপর তাহেরার সিটের কোণে গিয়ে দাঁড়ায়। টুলের দুই তক্তা পেরেক মেরে আটকে রাখা হয়েছে। ফাঁক আছে। ছফা চাচা বলতেন, স্বামী-স্ত্রী টুলের দুই তক্তার মতো। পেরেক গেঁতে জোর করে একসাথে রাখা হয়। তবু রাখা যায় না। আস্তে আস্তে ফাঁক হয়ে যায়।
ফাঁকে একটা চিঠি এমনভাবে গুঁজে দেই যাতে সহজে তাহেরার চোখে পড়ে।
চিঠি দিয়েছি; নাম দেইনি। উড়োচিঠি। মেয়েদের বিশ্বাস নেই। এরা ক্রিকেট বলকে কথার তোড়ে দুই মিনিটে ফুটবল বানিয়ে দিতে পারে। বাবার কানে গেলে ডান হাতের আঙ্গুল একটাও রাখবে না। স্কুল দূরে থাক, কলমও ধরতে পারবো না। তবু সাহস পাই। প্রেম ভীরুকে সাহস দেয়। এ বয়সে রবীন্দ্রনাথও প্রেম করেছেন, পত্র দিয়েছেন। নজরুলও করেছেন। আমি পারবো না কেন?
চিঠির নিচে বিঃ দ্রঃ দিয়ে লিখেছিলাম:
আমার সহিত প্রেম করিতে রাজি যদি হও রাণী,
বাথরুমের সানসেটে রাখিও উত্তরখানি।
পত্র দিলে তবেই আমার দিব পরিচয়
প্রেমের লীলা খেলে খেলে করবো তোমায় জয়।
সাধুচলিত মিশ্রণ। তাতে কিছু যায় আসে না। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতায় সাধুচলিত মিশ্রণ আছে।
ক্লাশমেট আলমাস রাজিয়াকে চিঠি দিতো। বিদ্যালয়ের পেছনে পেঁপে গাছের আড়ালে একটা ইটের নিচে প্রত্যুত্তর রাখার জন্য বিঃদ্রঃ দিয়েছিলো। আলমাস প্রতিদিন গভীর আবেগে ইট দুটো দেখতো। একদিন ইট উল্টে দেখে গু। কে যেন পায়খানা করে চাপা দিয়েছে। প্রেম পয়েন্টে গু। স্বর্গে যাবার পথে এমন আকামটা কে করলো! রাজিয়া দেয়নি তো?
আলমাসের গু-কেলেঙ্কারির পর আমি সানসেট বেছে নেই। নিরাপত্তার কোন বিকল্প নেই। সানসেটে হাগা সম্ভব নয়। গু-কেলেঙ্কারি পর আলমাসের নাম হয় গু-আলমাস। আস্তে আস্তে গুয়ালামাছ। স্যারেরাও ঐ নামে ডাকত।
ক্লাশ করছিলাম।
দফতরি কাশেম ক্লাশে ঢুকে টিচারকে কী জানি বলল। টিচার আমার নাম ধরে ডাক দেন: হেড স্যার তোমাকে ডেকেছেন।
চোরের মন পুলিশ-পুলিশ। হাত পা অবশ। হেড স্যার আমাকে কেন ডাকবেন? আমি ক্যাপ্টেন নই। ছাত্র হিসেবেও ভালো নই। এমন কোন প্রভাবশালী লোকের ছেলেও নই যে, ডেকে একটু খাতির করবে। আমার মনে টুলের ফাঁকের চিঠির বাজনা। বুকটা ধড়ফর করছে। প্রেম-টেম সেকেন্ডের মধ্যে উধাও। প্রভু; এবারের মতো রক্ষা করো।
প্রধান শিক্ষকের রুমে ঢুকার পর সনৎ স্যার আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দেন। যা ভেবেছি তাই। তাহেরাকে লেখা চিঠি।
এটা কী তোর লেখা?
আমি নিশ্চুপ।
সনৎ স্যার: চোরের দশ গৃহস্থের এক।
কী লেখেছো?
কী লিখেছিলাম এতদিন পর মনে পড়ছে না। তবে প্রতিটা অক্ষর ছিল কিশোর চেতনার মত অবিকশিত। যেমন কাঁচা তেমন অশোভন।
আমি কাঁপছি। চোখ একবার হেড স্যারের দিকে আর একবার সনৎ স্যারের দিকে। লজ্জায় মিলিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। ইস্ এ মুহূর্তে যদি অন্ধ হয়ে যেতাম! পুরো স্কুল ঘর ভেঙ্গে যেতো ভূমিকম্পে! কিন্তু অন্ধ হলে কী প্রলয় বন্ধ হয়! আমার প্রলয় আমার উপর দিয়ে যাবে।
হায় খোদা, প্রেম দিলে তো; এতো কষ্ট রাখলে কেন?
হেড স্যার: কুঠারের চেয়ে হাতল বড়ো হয়ে গেছে। একটু চেছে দেন তো সনৎ বাবু।
হেড স্যারের কথা শেষ হতে না হতে সনৎ স্যার আমাকে মারতে শুরু করেন। প্রচ- মার। আমি ব্যাথায় লাফাচ্ছি। সনৎ স্যার চুলের মুটি ধরে চিকন বেত দিয়ে পিটিয়ে যাচ্ছেন।
টুলে একটা চিঠি গুঁজে রাখার অপরাধ কতো মারাত্মক সেদিন আমি বুঝতে পেরেছি। কে চিঠিটা দিয়েছে? তাহেরা নাকি শিক্ষক নিজে পেয়েছেন?
মার খাওয়ার পর প্রেমোৎসাহে ভাটা পড়ে। তবে মার আমাকে বিখ্যাত করে দেয়। আমি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাই।
প্রেমের মড়া জলে ডুবে না- বন্ধুরা দেখলে টিটকিরি দিয়ে গেয়ে উঠতো। কিছু দিন পর সনৎ স্যারের পিটুনির কথা ভুলে যাই। মনে আবার জ্বলে উঠে তাহেরা।
কিন্তু তাহেরা দ্রুত নাদুস-নুদুস হয়ে উঠছে।
সে যত নাদুসনুদুস হচ্ছিল আমার মনটা তত খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। মোটা মেয়ে দু চোখের বিষ। দাদি বলতেন: মেয়ের বাড়ন লাউয়ের ডগা, পুরুষ বেটা কানী বগা। আমি প্রার্থনা করতাম, তাহেরা যেন মোটা না হয়। প্রার্থনা সফল হয়নি। ঈশ্বর বিশ্বাসে চিড় ধরে। সে থাকলে আমার এমন নিবেদিত প্রার্থনা রাখবে না কেন? এ তো এমন বেশি কিছু চাওয়া নয়।
কয়েক মাস পর এসএসসি পরীক্ষা। সবাই প্রস্তুতি-ছুটিতে। অনেকদিন তাহেরাকে দেখি না। সাত্তার আর তাহেরার বাড়ি পাশপাশি। সেও প্রেম করতো।
কোচিং শেষে ছাত্তারকে বললাম: তুই যদি তাহেরাকে আমার চিঠিখানা দিতে পারিস তো তোকে একটা চিঠি লিখে দেবো। এমন ভাষা দেবো, তোর প্রেমিকার দাদি-নানি হতে আরম্ভ করে মা-চাচি পর্যন্ত উন্মাদ হয়ে যাবে।
ছাত্তার রাজি।
সে আমার পত্রখানা তাহেরাকে না দিয়ে বাসার কাজের ছেলের হাতে দেয়। কাজের ছেলে তাহেরাকে না পেয়ে পত্রখানা তাহেরার মায়ের হাতে তুলে দেয়।
তাহেরার মা চিঠিখানা তুলে দেয় তাহেরার বাবার হাতে।
ইতিহাস শুরু হয়ে যায়।
কাজের ছেলের কাছে প্রেরকের পরিচয় পেয়ে তাহেরার মা-বাবা রেগে আগুন। ভাতিজিকে প্রেমপত্র! ছাত্তার আর তাহেরার দীর্ঘদিনের পারিবারিক বিরোধ। তাহেরার বাবা সাত্তারের পরিবারকে ঘায়েল করার মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে। এমন সুযোগ আর ছাড়া যায় না।
ছাত্তার মুলপত্র প্রেরক হিসেবে আমার নাম বলে দেয়।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুরো উপজেলা সয়লাব।
আমার মা-বাবা তাহেরার মা-বাবার চেয়েও বেশি ক্ষুব্ধ। আমি লজ্জায় ভেঙ্গে পড়ি। ছাত্তারকে বাড়ি হতে বের করে দিয়েছে, আমাকেও।
সন্ধ্যায় ছাত্তার এবং আমি স্কুলের পাশে বাঁশঝাড়ের নিচে মিলিত হই।
কী করবো?
ছাত্তার: এসো পালিয়ে যাই।
এমন সময় গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে আসে সনৎ স্যারের গল: পালাতে হবে না। তোমাদের জন্য কবর খোড়া হচ্ছে।

No comments:

Post a Comment