২০১৪ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন প্যাত্রিক মোদিয়ানোর। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে খ্যাতিমান ছোটগল্পকার এলিস মুনরো সাহিত্যে নোবেল পান। প্রাঞ্জল গদ্যে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা ফুটিয়ে তোলার অনবদ্য মুনশিয়ানার জন্য তাঁকে ‘কানাডার
চেকভ’ বলা হয়। সুইডিশ অ্যাকাডেমি ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ১১১তম লেখক হিসাবে ৬৯ বছর বয়স্ক মোদিয়ানোর নাম ঘোষণা করে। উল্লেখ্য মোদিয়ানো সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী একাদশ ফরাসি সাহিত্যিক। প্যাত্রিক মোদিয়ানো ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুলাই প্যারিসের বুলন শহরতলিতে জন্মগ্রহণ করেন। ইহুদি ধর্মাবলম্বী পিতা ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে দোমিনিক জাহফুসের সঙ্গে মোদিয়ানো বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭৪ ও ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের দুই মেয়ে
মোদিয়ানো মূলত ঔপন্যাসিক। তবে শিশু-সাহিত্যিক হিসেবেও তিনি সমান দক্ষ। তাঁর উপন্যাসগুলো কমপক্ষে ৩০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ইংরেজিতে অনূদিত তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে রু দে বুতিক অবসকিউর (দ্য মিসিং পারসন), ভয়্যাজ দো নোস (হানিমুন), লা রন্দ দো নুই (নাইট রাউন্ডস), দু প্লু লোয়াঁ দো লুবলি (আউট অব দ্য ডার্ক), দোরা ব্রুদার (দ্য সার্চ ওয়ারেন্ট), লে বুলভার্দ দো সোন্তিউ (রিং রোডস: অ্যা নোভেল)। লাকোম্ব লুসিয়াঁ নামের একটি ফরাসি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য যৌথভাবে লিখেছেন মোদিয়ানো। তাঁর সাম্প্রতিক বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে।
নোবেল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, ফ্রান্সে ১৯৪০ থেকে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জার্মান দখলদারির সময় সাধারণ মানুষের জীবনের গল্প নিজের বিভিন্ন লেখায় মোদিয়ানো নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘স্মৃতির শিল্প’ দিয়ে তিনি মানুষের ভাগ্যের সে সব দিক বর্ণনা করেছেন, যেগুলো প্রকৃতপক্ষে মুঠোয় ধরা সবচেয়ে কঠিন। কেনিয়ার লেখক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো, জাপানের লেখক
মোদিয়ানো ফ্রান্সে সবচেয়ে সমাদৃত লেখকদের একজন। তিনি দেশটির শীর্ষ সাহিত্য পুরস্কার প্রি গঁকুর পেয়েছেন ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তী তিন দশক ধরে বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখে তিনি সাহিত্যিক হিসেবে নিজের কৃতিত্বকে বিশ্বমহলে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। নিজেকে তিনি প্রকাশ করেন এভাবে - ‘আসলে, আমি কখনো অন্য কিছু করার কথা ভাবিনি। আমার কোনও ডিপ্লোমা ছিল না, অর্জনের জন্য কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যও ছিল না। তবে তরুণ লেখক হিসেবে শুরু করাটা ছিল আসলেই কঠিন। আমি নিজের প্রথম জীবনের বইগুলো পড়তে পছন্দই করি না। তার মানে এই নয় যে আমি সেগুলো অপছন্দ করি, তবে এ সব লেখায় আমি নিজেকে চিনতে পারি না -নিজেকে তরুণ অবস্থায় দেখতে একজন প্রবীণ অভিনেতার যেমন অনুভূতি হয়।’
মূলত তিনি ঔপন্যাসিক। তবে শুধু উপন্যাস নয়, শিশুসাহিত্য, এমনকি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও তিনি লিখেছেন। তবে তার সবচেয়ে পরিচিত কাজ সম্ভবত ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘রুই দে বুটিক অবসকিউর’ (ইংরেজি অনুবাদম মিসিং পারসন), যে উপন্যাসের জন্য তিনি সম্মানজনক ‘প্রি গুনকুয়া’ পুরস্কার লাভ করেন। এ উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে এমন এক গোয়েন্দাকে ঘিরে, যিনি ঘটনাচক্রে স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন এবং জীবনের শেষ ‘কেইস’ হিসাবে নিজের পরিচয় উদ্ঘাটনের তদন্তে নেমেছেন। এই অন্বেষণে ইতিহাসের পাতায় তিনি অনুসরণ করে চলেছেন নিজেরই ফেলে আসা পদচিহ্ন। সুইডিশ
অ্যাকাডেমির সেক্রেটারি পিটার ইংলান্দ বলেন, “আকারে ছোট, ১৩০ থেকে ১৫০ পৃষ্ঠার এক একটি বই। অধিকাংশ কাহিনীতেই ফিরে ফিরে এসেছে স্মৃতি, স্মৃতিলোপ, আত্মপরিচয়ের সঙ্কট আর নিজের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা।”মোদিয়ানোর বহু উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে তার শৈশবের প্যারিসে। তারই জীবনের টুকরো টুকরো অংশ নিয়ে গল্পের পরিণতির দিকে এগিয়েছে এক একটি চরিত্র। কখনও কখনও তিনি উপন্যাসের মাল-মসলা সংগ্রহ করেছেন মানুষের সাক্ষাৎকার থেকে, পত্রিকার নিবন্ধ থেকে, কখনও বা নিজের ডায়েরিতে লেখা নোট থেকে, বছরের পর বছর ধরে যা তিনি লিখে চলেছেন। কখনও আবার মোদিয়ানোর একটি উপন্যাসের গল্প থেকেই জন্ম নিয়েছে আরেকটি উপন্যাস, এক কাহিনীর চরিত্র অন্য কোনও উপন্যাসে হাজির হয়েছে ভিন্ন কোনো প্রেক্ষাপটে।
স্টকহোমে এক সংবাদ সম্মেলনে অ্যাকাডেমির সেক্রেটারি পিটার ইংলান্দ বলেন, অনবদ্য শৈল্পিক স্মৃতিগ্রন্থনার জন্য প্যাত্রিক মোদিয়ানোকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। যার মাধ্যমে তিনি মানব-ভাগ্যের দুর্বোধ্যতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, উন্মোচন করেছেন আগ্রাসনের বিশ্বে জীবনের বর্ণীল স্বরূপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দখলদার নাৎসি বাহিনীর অধীনে ফ্রান্সের মানুষের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা এবং নিজ শৈশবের বিভিন্ন দুঃসহ স্মৃতি তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সে সব ইতিহাস আর আপন অনুভূতির মিশেলে তিনি তরুণ বয়স থেকে একের পর এক সৃষ্টি করেছেন অনবদ্য উপন্যাস। ফরাসিভাষী প্যাত্রিক মোদিয়ানোর ‘স্মৃতির শিল্প’ এ বছর সুইডেনের নোবেল কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতি অর্জন করেছে বিরল মর্যাদায়। যা তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে। আগামী ১০ ডিসেম্বর স্টকহোমে আনুষ্ঠানিকভাবে মোদিয়ানোর হাতে পুরস্কার বাবদ তুলে দেয়া হবে ৮০ লাখ ক্রোনার। আমরা তাঁর স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
আলবার্তো মোদিয়ানো ছিলেন ইতালীয় ব্যবসায়ী এবং মা লুইজা কোলপেন ছিলেন বেলজিয়াম-অভিনেত্রী। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মোদিয়ানো প্যারিসের লুসি অঁরি-৪ সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে অধ্যয়নকালে তিনি শিক্ষক হিসাবে বিখ্যাত লেখক রেমো কুইনোর সঙ্গলাভের সুযোগ পান। কুইনোর উৎসাহ আর পরিচর্যা মোদিয়ানোর সাহিত্য জীবনের ভিত্তি গড়ে দেয়। কুইনো নিজেই মোদিয়ানোকে ফ্রান্সের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা গ্যালিমার সঙ্গে মোদিয়ানোর যোগাযোগ ঘটিয়ে দেন। মোদিয়ানো তরুণ বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন ছেড়ে দিয়ে লিখতে শুরু করেন। তাঁর দাবি, তিনি জন্মের আগের স্মৃতিও লেখার মধ্যে তুলে ধরতে পারেন। নিজের লেখার ধরন সম্পর্কে উনিশ শতকের ফরাসি লেখক স্তন্দালকে উদ্ধৃত করে মোদিয়ানো বলেন, ‘আমি ঘটনার বাস্তবতা দিতে পারি না, শুধু ছায়াটাকে উপস্থাপন করতে পারি।’
No comments:
Post a Comment